বেশ কয়েক বছর আগের কথা, একটা প্রোগ্রামে অংশ নিয়েছিলাম।আমার আবার এসব জায়গায় টাকা খরচ করে হলেও যাবার শখ থাকেই কারন,এগুলাতে অনেক কথা শোনা যায়।
ঐ প্রোগ্রামের একজন স্পিকার উদ্যোক্তাদের নিয়ে তথ্য উপাত্ত দিয়ে, খুব বাস্তব কিছু কথা বলেছিলেন যা আমার মনে ছিলো এবং আমি কথাটাকে খুব সিরিয়াসভাবেই নিয়েছিলাম।
চাকুরিজীবীদের মধ্যে ৯০% মানুষ, তাদের চাকুরিতে সন্তুষ্ট নন, তারা চাকুরি ছেড়ে দিয়ে স্বাধীনভাবে কিছু করতে চান। মজার ব্যাপার হচ্ছে এদের মধ্যে মাত্র ১০% চাকুরি ছেড়ে দিয়ে উদ্যোক্তা হবার জন্য কিছু একটা শুরু করেন আবার এই ১০% এর মধ্যে মাত্র ১% সফল হন। বাকীরা মানে ৯% পাবলিক হাল ছেড়ে দিয়ে, আবার চাকরী শুরু করেন। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে ১% থেকে কম মানুষ সফল উদ্যোক্তা হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে।
একজন উদ্যোক্তার জীবন হাজার গুন কঠিন, এর থেকে চাকরী করা অনেক সহজ,আমি আমার অভিজ্ঞতার আলোকে বলছি,কেউ আবার এটাকে অন্যভাবে নিবেন না।
আমার ফেসবুকে অনেক উদ্যোক্তা আছেন বলেই আমি ওনাদের অনেক কে দেখতে পারি।তারমানে এটা নয় যে,আমার সাথে চাকুরীজীবি কারো কোন সম্পর্ক নেই বা তারা আমাকে দেখেন না বা ভালবাসেন না।বরং,ওনারা আমাকে অনেক ক্লায়েন্ট রেফার করেন এটা ভেবে যে,আপনি শুরু করতে চাইলে সৌভিক ভাই বা
ICT CARE এর সাহায্য নিতে পারেন।
ইদানীং দেখি অনেকেই চাকুরীকে হেয় করে কটু কথা বলেন, এটা আসলে ভুল, কারন সবাই যেমন উদ্যোক্তা হতে পারবেনা ঠিক তেমন সবাই চাকুরীও করতে পারবেন না।
সবাই চাকুরী করবে এটা যেমন হয় না, আবার সবাই উদ্যোক্তা হবে এটাও সম্ভব না। বরং আমি মনে করি ভাল একটা চাকুরী,সুন্দর একটা পরিবেশ আপনার মেধার বিকাশ ঘটাবে, এই চাকুরী থেকে যে অমূল্য শিক্ষা আপনি পাবেন, সেটা আজীবন আপনার কাজে আসবে। সত্যি বলতে আমার জীবনে করা সকল চাকূরীগুলি থেকে শিক্ষা নিয়েই আমি আমার উদ্যোক্তা জীবনে টিকে আছি।
আমার সার্কেলের কাজই হলো হুটহাট ঘুরে বেড়ানো।তো আমি ছিলাম প্রচুর ঘুরে বেড়ানো পাবলিক।অথচ আমি গত ১০ বছরের মধ্যে- আমার মামা,খালা,ফুফু কারো বাসায় আমার সেভাবে যাওয়াই হয়নি।
বিগত বছরগুলি এত ভিন্ন হবার পিছনে কারন হল- আমার উদ্যোক্তা জীবন। এই গেলো বছরের ব্যাপারটাই তো সবথেকে ভিন্ন।টোটালি ৩/৪ টা ট্যুর দিয়েছি যার আমার লাইফেই সবচেয়ে কম।
চাকরী ছেড়ে দিয়ে উদ্যোক্তার জীবন বেছে নিয়েছি প্রপারলি। জীবন থেকে ট্যুর ছুটি উধাও হয়ে গেছে। অফিস শেষে বাসায় এসে, আরো কয়েক ঘন্টা পিসির সামনে সময় দিতে হবে, বলা যায় ঘুমানোর সময় বাদ দিয়ে, সারাদিন অফিস নিয়ে চিন্তা করতে হয়। অফিস চালানো, এমপ্লয়িদের বেতন সহ সব মিলিয়ে বড় একটা খরচ। এই খরচ মেটাতে যেয়ে বাড়তি পরিশ্রম করতে হয়। আসলে উদ্যোক্তার জীবন বড়ই কঠিন। এইজন্য আমি জন্য সব সময় দোয়া করি, আল্লাহ্ যেন সকল উদ্যোক্তাদের সাথে আমাকে থাকার তৌফিল দেন এবং আমাকে তাদের স্বপ্নের কাছে পৌছে দিতে সাহায্য করার সুযোগ দেন।
আমার নিজের উদ্যোক্তা জীবনের গল্প বলতে পারি। ২০১৪ সালের ১লা মে নিজের অফিস দিই, অর্থাৎ আমার উদ্যোক্তা লাইফের ১০ বছর পূর্ণ হতে চলেছে। আমি সহ মাত্র ১৫ জন নিয়ে আমার ছোট এই অফিস, এরমধ্যে রোমোটলি কাজ করে ১০ জন আর অফিসে ৫ জন।
শুনলে অবাক হবেন যে আমার এই ছোট অফিসে, আমি গত ১০ বছরে সব মিলিয়ে ৭৫-৮০ লাখ টাকা ব্যায় করেছি। আমার অফিসের পিসি কেনা থেকে শুরু করে একটা আল পিন কেনার হিসাবও আমি রাখি এই জন্য পুরা হিসাবটা বলতে পারলাম।
এই ১০ বছরে আমার আগের যা সামান্য সঞ্চয় করেছিলাম, সব ব্যায় করেছি। কষ্টের কথা হচ্ছে এই অফিস থেকে আমার ROI (Return of Investment) হচ্ছে ৮-১০ লাখের মত,একটা জমি কিনতে গিয়ে এখন তাও কাছে নেই।
মজার ব্যাপার হচ্ছে আমি এই বছরে আবার শুন্য থেকে শুরু করছি।এই অফিস না দিয়ে আমি যদি আগের মত কাজ করতাম।তাহলে অন্তত ৫০% -৬০% সেভ হতো।
কতবার যে চিন্তা করেছি যে আগামী মাসেই অফিস বন্ধ করে দেব তার কোন ইয়াত্তা নেই। কিন্তু প্রতিবারই ফেরত এসেছি। আসলে একজন উদ্যোক্তা হতে গেলে বড় কলিজা লাগে, সবাই এটা পারে না। মাসের পর মাস কর্মচারীদের বসিয়ে বসিয়ে বেতন দিয়েছি, কত যে ভুল করেছি এবং তা থেকে শিক্ষা নিয়েছি সেটা বলে শেষ করা যাবে না। আমার মত একজন ছোট উদ্যোক্তার জীবন যদি এত কঠিন হয়, তবে যারা বড় বড় স্টার্টআপ নিয়ে কাজ করে তাদের অবস্থা কেমন একটু চিন্তা করেন।
আমি যে কথাগুলো বললাম এসব কথা কেউ বলবে না। চারপাশে দেখবেন উদ্যোক্তা হও, নিজে থেকে কিছু কর, বলে সবাই উৎসাহ দেবে। কারন আর কিছুই না উদ্যোক্তা হবার স্বপ্ন দেখিয়ে কোর্স করিয়ে বা অন্য কোন উপায়ে আপনাদের দিয়ে ভাল ধান্দা করা যাবে। আপনি যখন সর্বস্ব হারিয়ে পথে বসে যাবেন, তখন এসব স্বপ্ন বেচার ধান্দাবাজদের কাউকে খুঁজে পাবেন না।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে এত নেগেটিভিটি থাকা স্বত্বেও মানুষ কেন উদ্যোক্তা হয়? এর উত্তর হচ্ছে কিছু মানুষই এমন ভাবে তৈরি হন, যারা স্বাধীনচেতা, নিজের মেধাকে কাজে লাগিয়ে, জীবনে বড় কিছু করতে চায়, বড় কিছু হতে চায়, নিজের স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করতে চায়, বাঁধাধরা জীবন তারা পছন্দ করে না, মুক্ত স্বাধীন জীবন যাপন করতে চায়।
উদ্যোক্তার জীবনের যে আসল মজা, সেটা একমাত্র সফল উদ্যোক্তা হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার পরেই বোঝা যায়, এর আগে নয়। পরিশেষে বলব যদি উদ্যোক্তার জীবন বেছে নিতে চান, তবে অনেক ভেবে চিন্তে সঠিক পরিকল্পনা এবং ভাল একটা ব্যাকআপ নিয়ে এর পরে আসবেন।
সঠিক পরিকল্পনা কাজের অর্ধেক, ইনশাআল্লাহ আশা করা যায় আপনি সফল হবেন। ভয় পাবার কিছু নেই, পথে নামলে পথই পথ দেখায়।