সেই ১৯৭৬-৭৭ এর কথা (আমার নিজের চোখে দেখা না,শুনেছি মাত্র) একজন নারী চিন্তা করলেন তিনি রান্নাটাকেই শিল্প বানিয়ে ছাড়বেন।কিন্তু আসলে ইচ্ছা জাগলেই তো হবেনা,তাকে সাপোর্ট করে এগিয়ে নেবার দ্বায়িত্বটাও তো কাউকে নিতে হবে।
আসলে এত উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তার মেয়ে আবার বউ হবার পরে ঠিক রান্না করে মানুষ খাওয়ানোটা কেমন যেন নোনতা নোনতা আর সম্মানহানির বলে মনে হয়,তাইনা বলেন সুশীল সমাজ?
ম্যাসেজ পড়ে বুঝেছিলাম- মনের মধ্যে অনেক সংকোচ আর অজানা ভয় নিয়ে ম্যাসেজটা করেছেন।কোন কিছু না জানাটা বোধহয় খুব অন্যায় এমন কিছু।আমি সচারাচর ম্যাসেজে উত্তর দিতে পারলে মোবাইলে কথা বলিনা,কিন্তু আপুকে কল করেছিলাম।কথাও হয়েছিলো বেশ।খুব বেশি মেমরী আমার খারাপ না হলে বলা যাচ্ছে উনি হয়তো ৫০০/৭০০ টাকার একটা সার্ভিস চেয়েছিলেন।
আমি বুঝেছিলাম ওনার সমস্যাটা কোথায়।তাই অভয় দিয়ে কাজটা করে আমি রিপোর্ট দিই আপুকে।আস্তে আস্তে জানতে পারি সবটা।সেই ১৯৭৬/৭৭ এ যে মানুষটা একটা ছোট্ট করে হলেও খাবারের স্থান তৈরির স্বপ্ন দেখেছিলেন সেই মানুষটাই একদিন একটা ছোট্ট রেষ্টুরেন্ট দিলেন- Zahra’s kitchen.
ওনার স্বপ্ন অনুযায়ী না হলেও চলে যাচ্ছিলো বেশ,কিন্তু করোনার প্রকোপে ১৮ মাসে প্রায় ২০ লক্ষ টাকা লস গুনলেন এই উদ্যোগ নিয়ে।চারজন কর্মচারীদের বেতন দিয়ে এসেছেন এই কোভিডের সময়েও।কথা হলেই বলতেন- ওরা কোথায় যাবে সৌভিক?
ভাবুন তো,অনেক বড় বড় কোম্পানিই ছাঁটাই করেছেন কিন্তু উনি করেননি।লেগে থেকেছেন আর আছেন ও।খুব সম্ভ্রান্ত একটা পরিবার আর খুব সম্ভ্রান্ত একটা বন্ধু সাইকেল আছে আপুর,যেখানে বন্ধুদের সাথে বন্ধুত্বটা ৪৫ বছরের।এবং সেগুলি এখনো চলমান (সেকথা নাহয় একদিন আলাদা করে লিখবো)।
সেই বড় সাইকেলের সুত্র ধরেই ধানমন্ডির খুব অভিজাত এলাকায় (অর্চার্ড পয়েন্টের ঠিক মুখেই আপুর বড় যত্নে গড়া স্বপ্নের ছোট্ট স্পেস) একটা খাবারের দোকানই বলবো আমি।তার আশে পাশেই অনেক নামীদামী স্কুল,কলেজ।
এইবার ঢাকাতে যেয়ে আমি এইরকম একটা জায়গায় কথা বলছিলাম – ওনারা বললেন ভালো মানের খাবারের বড্ড অভাব স্যার,কিন্তু আমাদের কর্তৃপক্ষ যেন ব্রান্ডেড কিছু ছাড়া চোখেই দেখেনা।হঠাৎ আমার মাথায় এলো আপুর কথা।আপুকে জানাতেই আপু বললেন- সৌভিক,তারিক আনাম খান,সুবীর নন্দীর পরিবার,তার মেয়ে সবাই আমার দোকানের খাবারের প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন।আমার খুব কাছের মানুষ তারা।আমি সানিডেলেও টিফিনের খাবার দিয়ে শুরু করেছিলাম,কিন্তু কালের পরিক্রমায় হয়তো কোন কারনে,আমার অজানা কোন কারনেই এখন সবাই ব্রান্ডেড খোঁজে।তাই তুমি বলেছো,আমি হয়তো যাবো কিন্তু ওরা প্রসেস করে আমায় বাদ দেবে,কারন আমি তো কর্তৃপক্ষের জন্য আলাদা কোন বাজেট রাখবোনা।
আমি বললাম- ১৫% লভ্যাংশ রাখবেন আর ৫% সেখান থেকে কর্তাদের দিয়ে দেন।
আপু হেসে বললেন- সৌভিক,আমি বিশ্বাস রাখি আমার খাবার শতভাগ শুদ্ধ এবং স্বাস্থ্যকর তাই কাউকে হাতে ধরে খাবার দিবোনা।আর তুমি আমায় পরীক্ষা করলে তা বুঝি আমি।
আমি খুব অবাক হলাম এবং খুশিও হলাম আপুর কথায়,তাই এবার ঢাকাতে আমি আপুকে নিয়েই প্ল্যান করেছি।এক পর্যায়ে জানতে পারলাম- বয়সে ছোট দুইজন ব্যাক্তি
Razib Ahmed স্যার আর আমায় কেন্দ্র করেই নাকি তার গ্রুপে থাকা ও মোবাইল চালানো।
আপু আমার কাছে রিডিং সিলেবাস সম্পর্কে জানতে চাইলো- বললো আমিও পড়ি,যদি এতে আমার স্বপ্নের জন্য কাজে আসে।
আমি অবাক হলাম যে এই বয়সেও এভাবে ভাবতে পারেন?
আমরা কোথায়?
৪৫ টা বছর তিনি পরিশ্রম করছেন শুধুমাত্র এই স্বপ্ন এঁকে যে ওনার স্বপ্ন বাস্তবায়ন হবে,আর মানুষ স্বাস্থ্যকর খাবার খাবে।
স্বপ্ন বাস্তবায়ন করেছেন কিন্তু হেরে যেতে বসেছিলেন এই অনলাইনের অর্ডারের কাছে।
কারন উনিযে জানেননা কিছুই অনলাইনের।আমি আমার পরিবারের জন্য কেক এনেছিলাম ঢাকা থেকে আর ওনার শপে ও বাড়িতে যেয়ে খেয়েছিলাম- এত অতুলনীয় স্বাদ আমি ঢাকাতে এমন সুস্বাদু খাবার কোথাও খাইনি।
একটা ইভেন্টে ওনার রান্না নিয়েছিলাম- ১০০ মানুষই বলেছিলো, ভাই খাবারের স্বাদ এতটাই ভালো যে আমাদের কাছে মনে হয়েছিলো খাবার কম হয়ে গেলো।
আমরা অনেকেই স্বপ্ন পুরনের জন্য পরিশ্রম করি আর ভাবি- সফলতা কবে ধরা দিবে?
আর এই মানুষটা কাজ করছেন ৪৫ বছর।যেখানে সাপোর্টিভ কেউ ছিলোনা,আজও যে আছেন এমন সংখ্যা নেই বললেই চলে।
আমি এই আপুর পাশে দাঁড়িয়েছি এইজন্যই যে- অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ আর অস্বাস্থ্যকর খাবার থেকে বেরিয়ে এসে যেন আমরা হোম মেইড খাবার খেতে পারি এবং সেটা যেন সত্যিই স্বাস্থ্যকর হয়।
ওনার দোকানের খাবারের দাম দেখে
Farhana Akter Lucky আপু আর
M M Abu Sina বলছিলো- স্বপ্নের পিছনে ছোটা বোধহয় একেই বলে।নইলে এত অল্প মুল্যে ঢাকাতেও খাবার পাওয়া যায়?
খাবারের যে স্বাদ তাতে এই মুল্য নিলে লাভটা কোথায়?
অনেক যোদ্ধার গল্পতো আমরা পেপার পত্রিকায় খুঁজে পড়ি কিন্তু ঘরের কোনায় রয়ে যাওয়া এই অনুপ্রেরণার বারুদটাকে কতটুকু চিনি?
আসুন আমরা সকলেই এমন যোদ্ধাদের সম্মান করি এবং ওনাদের জন্য নিজেরা অনুপ্রেরণা খুঁজে ফিরি।