সফলতা আর রিভেঞ্জ অফ ন্যাচার

মেয়েটার সাথে ছেলেটার যখন রিলেশন হয় তখন না ছেলেটা বুঝতো আর না মেয়েটা বুঝেছিলো যে তারা একে অপরকে ভালোবাসে। ছেলেটার প্রতি মেয়েটার মুগ্ধতা চোখে লেগে থাকার মত হলেও ছেলেটাকে সেভাবে কখনো দেখা যেতোনা।বরং বন্ধুদের সার্কেলে ছেলেটা ভীষণভাবে জনপ্রিয় ছিলো তার নানান ক্রিয়েটিভ কাজের জন্য।
রিলেশন যখন হলো, মেয়েটা তখনো চোখে মুখে মুগ্ধতা নিয়েই স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে কলেজে পৌছে গেলো,এবং মেয়েটার সার্কেলের সকলেই জানতো এই মেয়ের সফলতার পিছনে সকলের প্রিয় স্বপ্ন ভাইয়ার অবদানই সব।
ভাইয়া ভার্সিটিতে কম্পিউটার সায়েন্সে চান্স পেয়ে চলে গেলো এলাকা ছেড়ে,আমিও যখন ঐ একই ভার্সিটিতে চান্স পেলাম,যাবার পরে আমি সহ আমাদের এলাকার অনেক ভাইয়ার জন্য হোষ্টেলের সিট ভাইয়াই করে দিয়েছিলো। একই ডিপার্টমেন্টে এবং একই এলাকার বলেই ভাইয়ার সাথে সক্ষ্যতা ভালো ছিলো এবং ভাইয়ার সকল ব্যাপারই চোখে পড়তো।
ভাইয়াকে যে মেয়েটি ভালোবাসতো বলেই জানতাম সকলে সেই মেয়েটির নাম ছিলো- “ফাইজা” আর ভাইয়ার নাম তো বললাম যে, স্বপ্ন।
যদিও ভাইয়া আমাদের সিনিয়র, কিন্তু ক্যাম্পাসে ভাইয়াকে পছন্দ করতো না আবার ভাইয়ার ভক্ত ছিলোনা এমন মানূষ খুঁজে পাওয়া দুস্কর। ভাইয়াকে কোনদিন হাসি ছাড়া দেখিনি। এমন ভদ্র ছেলে পুরো ক্যাম্পাসে পাওয়া দুষ্কর ছিল। জুনিয়র হোক কিংবা সিনিয়র হোক,সকল মেয়েরই পছন্দের ছিলো ভাইয়া,আর ছেলেদের হিসাব তো কাউন্ট করে পারা যাবেনা।যেমন মেধাবী ঠিক তেমনই হাস্যজ্বল।
ফাইজা আপুকে ভালোও বাসতেন পাগলের মতো। প্রায়ই দেখা যেতো ক্যাম্পাসে মোবাইল কানে নিয়ে ভাইয়া হেঁটে চলেছেন রোমান্টিক মুডে। আমাদের দিকে চোখে চোখ পড়তেই অবশ্য হাত থেকে মোবাইল নামিয়ে লাজুক হাসি দিতেন স্বপ্ন ভাই!
মাঝে মাঝেই রাত তিনটা-চারটায় ঘুম থেকে উঠে দেখতাম, হলের করিডোরের এক কোনায় দাঁড়িয়ে ভাই তখনও গুজুর গুজুর করেই চলেছেন!
একটা চাকরির স্ট্যাটাস আর বি সি এস ক্যাডার নামক পদবীর অভাবে সেই সম্পর্কটাই বদলে গেল কী ভীষণভাবে!
ততদিনে ভাইয়ের বি এস সি পাস করা শেষ। এম এস সি টাও করছেন এদিকে চাকরি পাচ্ছেন না বলে সেই প্রিপারেশন টাও নিয়ে চলেছেন দারুনভাবে।
জব কিংবা বি সি এস কোনটাই মনের মত হচ্ছিলোনা বলে ক্যাম্পাসের কাছেই এবং ঐ ইট-কাঠের শহরে ভাইকে আরো বছর ডের-দুই দেখা গিয়েছিল।
তবে এর মাঝেই মেয়েটা ছেড়ে চলে গিয়েছিল ভাইয়ার বি এস সি শেষের এক বছরের মাথায়। যাবেই না বা কেন, সুন্দরী মেয়ে, বাসায় বিয়ের প্রস্তাব এসেছে, সেই ছেলে আবার নাকি পুলিশের দারোগা,ইনকাম বেশ।
যাওয়ার আগে মেয়ে বলে গিয়েছিল, “চাকরি পাও না, যোগ্যতা নেই, তো প্রেম করতে এসেছিলে কেন?”
ব্রেকাপের পর ভাইয়ার সাথে দেখা হলে এগুলি নিয়ে যতটুকু বলতেন তাতেই জেনেছিলাম এইসব। হাতে সব সময় কোনো না কোনো হ্যান্ড নোটস থাকতোই।
ঘন্টার পর ঘন্টা পড়তেন আর মাঝেমাঝে উনার জীবনের গল্প বলে চলতেন। বাড়ির ঘরের কোণাটা ভেঙে পড়েছে, ছোট বোনটার বিয়ের বয়স হয়ে গিয়েছে, বাবার ব্যাবসাটা আবার অনেকটা কোমায় চলে গেছে ইত্যাদি।
মাঝেমাঝে কথা বলা বন্ধ করে সিলিং ফ্যানের দিকে তাকিয়ে থাকতেন। কি যেন ভাবতেন। হয়তো সে ভাবনা আমাদের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে!
এই সবের মাথায় স্বপ্ন ভাইকে প্রায় সকলেই ছেড়ে চলে গিয়েছিলো,ঠিক যারা ভাইয়ার জন্যই আজ এতদুর এসেছেন সেই বন্ধু বান্ধব কিংবা ছোট ভাই গুলি।
যেদিন ভাইয়াকে শেষবার দেখেছিলাম, অঝোর ধারায় চোখ থেকে পানি পড়ছিল। আমাকে দেখে চোখে পানি নিয়ে অনেক কষ্টে একটা হাসি দিয়ে বলেছিলেন, “আর যা কিছুই করিস, প্রেম করতে যাস না ভাই। জীবনটা ছাই বানিয়ে দেবে। “কথাটা কাগজে লিখে দেয়ালে টানিয়ে রেখেছিলাম!
উপরের কথাগুলো প্রায় বছর-দশক আগের যা আমার জীবনের অংশ।
নিজের ক্যারিয়ার সংক্রান্ত একটা কাজে বহুদিন ধরে চেষ্টা করছিলাম কোনো একটা উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা কিংবা এম পি টাইপের কারো সাথে যোগাযোগ করতে, বিষেশত, ভার্সিটির কোনো বড় ভাইয়ের সাথে। তাহলে হেল্প বেশি পাওয়া যাই।
খোঁজ খবর করতে যেয়ে একদিন দেখলাম স্বপ্ন ভাইয়ার একটা ইন্টারভিউ আর সেটাও চ্যানেল পাল্টাতে যেয়ে,আমার তো মাথা ঘুরে যাবার উপক্রম হলো।
স্বপ্ন ভাইয়া এখন অনেক সম্মানিত একজন ব্যাক্তিত্ব,একইসাথে অনেক সুপরিচিতও বটে।
সময় করে একদিন গেলাম ভাইয়ের অফিসে। সে অনেক সিকিউরিটি আর বেশ কয়েকজনের সাথে কথা বলার পরে জানতে পারলাম ভাইয়ার এপোয়েন্টমেন্ট পাওয়া যাবেনা আজ।
মনটা খারাপ করেই আসতে উদ্যত হলাম হঠাত সিকিউরিটি গার্ড ডেকে বললেন- আপনাকে স্যার ডাকছেন।
আমি অবাক হয়ে চলে গেলাম পা চালিয়ে, যেয়ে দেখি চকচকে সেক্রেটারিয়েট টেবিলের একপাশে বসে ছিলেন ভাই, আমাকে দেখে বিশাল এক হাসি দিয়ে এগিয়ে এসে বুকে বুক মেলালেন। একথা সেকথার পর উঠল, সংসার জীবনের কথা। বললাম, বিয়েটা করিনি এখনো ভাইয়া,ক্যারিয়ারের এই সেটেলমেন্ট টা খুব জরুরী।
সব শুনে ভাইয়া ফোন বললেন- সব কাগজ রেখে যেতে,আমি বলে দিব তোমার কাজ দুইদিনেই হয়ে যাবে। ভাইয়ের কথা জিজ্ঞেস করতেই বললেন, বিয়ে করেছেন। একটা ফুটফুটে বাচ্চাও হয়েছে। ভাবী আবার ব্যাংক জব ছেড়ে ভাইয়ার অফিসেই বসেন এবং একইসাথে সংসার সামলাচ্ছেন দারুনভাবে।
একটু চোখ মেলে তাকাতেই দেখলাম- অনিন্দ্য সুন্দরী ভাবী ও ভাতিজার ছবি। আমি অবাক হলাম কিন্তু এড়িয়ে যেয়ে,
অনেকক্ষণ যাবৎ মনের সধ্যে যে একটা কথা বাজছিল; শেষ পর্যন্ত সেটা জিজ্ঞেস করেই ফেললাম, “ফাইজার কথা মনে পড়ে না, ভাই?” বেশ বড়সড় একটা হাসি দিয়ে বললেন, “নাহ রে ভাই। কোন সুযোগ আসেনা।
জীবনে যা চেয়েছিলাম, তাঁর চেয়ে অনেক বেশি পেয়ে গিয়েছি। এখন আর এই সব ছোটখাট চাওয়াগুলো পাত্তা পায় না।”তোর ভাবী আমাকে এত ভালোবাসা দিয়েছে যে,আমার আর কোন দিকেই তাকানোর সময় নেই,সেই সাথে আছে এত মানূষের ভালোবাসা।
জিজ্ঞেস করলাম, “ফাইজা আপুর আর কোনো খবর পাননি?” কিছুক্ষন চুপ থেকে বললেন, “শুনেছিলাম বছরখানেক আগে ডিভোর্স হয়ে গিয়েছে। গ্রামেই এখন বাবার বাড়িতে থাকে,ঈদের নামাজ পড়তে যেয়ে ওর বাবার সাথে দেখা হলে জেনেছিলাম, এরপর আর কোনো খবর পাইনি।”
ভাইয়ার গাড়িতে এক সাথে ফেরার পথে ভাইয়ের কাছে জিজ্ঞাস করলাম- ভাইয়া, অফিসে পরিবারের ছবি রাখার কারন কি?
যা বলেছিলেন ভাইয়া সেটা আজ ও কানে বাজে “লাইফে কাউকে ঠকাতে নেই, আর পরিবার কে সামনে রেখে আমরা আসলে কাউকে ঠকাতে পারিনা। জীবন কাউকে ছাড় দেয় না, প্রতিশোধ নিয়েই ছাড়ে। রিভেঞ্জ অফ নেচার!”
সত্যিই, লাইফ কী ভীষণভাবে রং পাল্টায়! স্বপ্ন ভাইয়া আমায় নামিয়ে দিয়ে বের হতেই সেখানে অনেক লোকের সমাগম হয়ে গেলো মুহুর্ত্বেই,সকলের দাবী- ভাইয়ার একটা অটোগ্রাফ। ভাইয়া ঠিক আগের মতই হেসে হেসে কথা বলে চলেছেন দিব্যি।
সেই অনিন্দ্য সুন্দর হাসিমাখা মুখ, একটু দুরেই দেখলাম ফাইজা আপু মেয়েকে সাথে নিয়ে মুখে ঘোমটা টেনে একটা অফিস থেকে বের হয়ে চোখ মুছলেন,আমার চোখ ফাকি দিতে পারেনি সেই কান্না।
মোঃ সৌভিকুর রহমান
শিক্ষক (কম্পিউটার বিভাগ)
যশোর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট
আমার কাজ- লোগো ডিজাইন,ব্যানার ডিজাইন,বিজনেস কার্ড ডিজাইন,ফেসবুক পেজ ডেকোরেশন,ই-কমার্স ওয়েবসাইট ডিজাইন,পেজ প্রমোট ও বুষ্টিং,কন্টেন্ট রাইটিং,ভিডিও এডিটিং ও সফটওয়্যার ডেভলপমেন্ট নিয়ে।
আমার পেজ- ICT CARE

Newsletter Updates

Enter your email address below and subscribe to our newsletter

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *