নাগরিক অধিকারের বিপর্যয় ঘটিয়েছে ফেসবুক ?

নাগরিক অধিকারের বিপর্যয় ঘটিয়েছে ফেসবুক
নয় মাস ধরে ফেসবুক যেসব সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেগুলো নাগরিক অধিকারের ক্ষেত্রে গুরুতর বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে। বৈশ্বিক পর্যায়ে ফেসবুকের প্রভাব পর্যালোচনা করতে তাদেরই অর্থায়নে পরিচালিত দুই বছর মেয়াদি এক নিরীক্ষা (অডিট) প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।

২০১৯ সালের জুন মাস থেকে ফেসবুকের নেওয়া সিদ্ধান্তগুলোর বিষয়ে মূল প্রতিবেদনে প্রাথমিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সেখানে অবশ্য ফেসবুক টুল ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্রে বাসস্থান ও কর্মসংস্থান-বৈষম্য দূর করতে বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রে নেওয়া পদক্ষেপের প্রশংসা করা হয়েছে। তবে, নিরীক্ষকেরা বলছেন, ফেসবুকের নেওয়া অনেক পদক্ষেপেই নাগরিক অধিকারের ক্ষেত্রে বিপর্যয় ঘটিয়েছে। এটি শুরু হয়েছিল গত বছরের সেপ্টেম্বরে। ওই সময় ফেসবুকের প্রধান নির্বাহী মার্ক জাকারবার্গ বলেন, ‘ফেসবুকের সর্বাধিক আকাঙ্ক্ষিত মান হিসেবে মুক্ত মত প্রকাশের ক্ষেত্রে একটি নির্বাচনী দৃষ্টিভঙ্গি রাখবে।’
নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মুক্ত মত প্রকাশের স্বাধীনতা দেওয়া ভালো, তবে এটা সবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হওয়া উচিত। সমতা আর অবৈষম্যের মতো অন্য সব মূল্যবোধের তুলনায় মুক্ত মত প্রকাশের অগ্রাধিকারের বিষয়টি নিরীক্ষকদের কাছে ঝামেলার বলে মনে হয়েছে। এটি নাগরিক অধিকারের ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছে এবং নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে।


নিরীক্ষকেরা বলেছেন, ফেসবুক ট্রাম্পের মতো রাজনীতিবিদদের বক্তব্যের ক্ষেত্রে কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ার ফলে অন্যান্য রাজনীতিকের ভোটের ক্ষেত্রেও ফেসবুক ব্যবহার করে হস্তক্ষেপ করার সুযোগ তৈরি করেছে।
নিরীক্ষকদের বরাতে বার্তা সংস্থা রয়টার্স বলেছে, ফেসবুক তাদের প্ল্যাটফর্মে বৈষম্য দূর করার ক্ষেত্রে যথেষ্ট ব্যবস্থা নেয়নি। তাদের সিদ্ধান্তে অধিকাংশ নাগরিক অধিকার সংস্থাগুলো আঘাত পেয়েছে।
‘গার্ডিয়ান’-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ফেসবুক থেকে ইতিমধ্যে ৯০০ বিজ্ঞাপনদাতা সরে যাওয়ার পর এ প্রতিবেদন বাড়তি চাপ সৃষ্টি করবে।
ফেসবুকের একজন মুখপাত্র বলেছেন, ‘এ নিরীক্ষায় গভীর বিশ্লেষণ করা হয়েছে যাতে আমরা আমাদের নাগরিক অধিকারের বিষয়টি আরও শক্তিশালী করতে পারি। এটা কেবল যাত্রার শুরু, শেষ নয়।’
নিরীক্ষার ফলকে স্বাগত জানিয়ে ফেসবুকের প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা শেরিল স্যান্ডবার্গ বলেন, ‘আমাদের যে দুর্বলতাগুলো বিশেষজ্ঞরা উন্মোচন করেছেন, তা মেনে নেওয়া কঠিন। তবে সন্দেহাতীতভাবে এটা আমাদের কোম্পানির গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া। আমাদের খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোকে এ পথ নিতে বলব।’

নিরীক্ষকেরা ফেসবুকে যেসব পরিবর্তন আনার পরামর্শ দিয়েছেন, তার বেশ কিছু বাস্তবায়ন করার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে ফেসবুক। এর মধ্যে নাগরিক অধিকারকর্মী নিয়োগ, প্রতারণধর্মী বিজ্ঞাপন বন্ধ, কৃষ্ণাঙ্গদের ক্ষুদ্র ব্যবসায় বিনিয়োগ প্রভৃতি বিষয় রয়েছে। শেরিল স্যান্ডবার্গ অবশ্য বলেছেন, সব পরামর্শ তাঁদের পক্ষে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অলাভজনক প্রতিষ্ঠান মুসলিম অ্যাডভোকেটসের নির্বাহী পরিচালক ফারহানা খেরা বলেন, ‘নিরীক্ষায় দেখা গেছে, নানা উপায়ে মুসলমান ও অন্য ঝুঁকিপূর্ণ সম্প্রদায়ের নির্লজ্জভাবে ক্ষতি করেছে ফেসবুক। তার চেয়েও নির্লজ্জের বিষয় হচ্ছে, এই যন্ত্রণা ও সহিংসতা বন্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে অস্বীকার করেছে কোম্পানিটি।’

ঘৃণ্য বক্তব্যের বিরুদ্ধে ফেসবুক কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় এ প্ল্যাটফর্ম থেকে বড় বড় বিজ্ঞাপনদাতা সরে যাচ্ছেন। ফেসবুক বর্জনের ডাক দিয়ে চালু করা আন্দোলন ‘#স্টপহেটফরপ্রফিট’ জোরদার হচ্ছে। ফেসবুক থেকে বিজ্ঞাপন বর্জনের তালিকায় নাম লিখিয়েছে ইউনিলিভার, কোকা-কোলার মতো ব্র্যান্ড।
ফেসবুকের যে পরিস্থিতি, এতে এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মার্ক জাকারবার্গ বেশ আত্মবিশ্বাসী। তিনি বলেন, ফেসবুক তার অবস্থান বদলাবে না। ঘৃণ্য বক্তব্য নিয়ে পাঁচ শতাধিক বিজ্ঞাপনদাতা ফেসবুক প্ল্যাটফর্ম বর্জনের ঘোষণা দেওয়ার প্রতিক্রিয়ায় জাকারবার্গ এ কথা বলেছেন। দ্য ইনফরমেশনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিজ্ঞাপনদাতারা ফেসবুক ছাড়ার বিষয়টি নিয়ে প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের সামনে জাকারবার্গ আত্মবিশ্বাসী মন্তব্য করেছেন।
জাকারবার্গ বলেছেন, ফেসবুক বর্জনের ঘোষণার সঙ্গে সম্মানের বিষয়টিও জড়িত। এটি ফেসবুকের আয়ের সামান্য অংশে হুমকি হতে পারে। যেসব বিজ্ঞাপনদাতা সরে গেছেন, তাঁরা শিগগিরই আবার ফেসবুকে ফিরে আসবেন।
ঘৃণ্য বক্তব্য বিষয়ে অবস্থান নিয়ে ফেসবুক নেতৃত্বের ওপর খেপেছে ফেসবুকের বিরুদ্ধে আন্দোলনকারী সিভিল রাইটস ও অ্যাকটিভিস্ট গ্রুপগুলো। মঙ্গলবার ফেসবুকের প্রধান নির্বাহী মার্ক জাকারবার্গসহ প্রতিষ্ঠানটির শীর্ষ পর্যায়ের কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে ভার্চ্যুয়াল আলোচনায় বসেছিল আন্দোলনকারীরা। তবে আলোচনা ফলপ্রসূ হয়নি। ফেসবুক তাদের জায়গায় অনড়। তারা আন্দোলনকারীদের দাবিদাওয়া কানে তোলেনি বা কোনো কিছু করার প্রতিশ্রুতি দেয়নি।
ফেসবুকেরই করা নিরীক্ষা প্রতিবেদনে তাদের প্ল্যাটফর্মে বৈষম্য রাখা ও যথাযথ ব্যবস্থা না নেওয়ার যে চিত্র ফুটে উঠেছে, তাতে আন্দোলনকারীদের দাবি আরও জোরালো হবে বলেই মনে হচ্ছে।

Newsletter Updates

Enter your email address below and subscribe to our newsletter

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *